রাজা রামমোহন রায় নিয়ে এখন যা হৈচৈ চলছে
রাজা রামমোহন রায় মানে যিনি সতীদাহ প্রথা বন্ধ করিয়েছিলেন, মেয়েদের পড়াশোনার পথ খুলে দিয়েছিলেন, ব্রাহ্মসমাজ গড়েছিলেন – সেই মহান মানুষটাকে হঠাৎ একজন মন্ত্রী বলে বসলেন “ব্রিটিশদের দালাল”।
কী হলো আসলে?
১৫ নভেম্বর মধ্যপ্রদেশের একটা অনুষ্ঠানে বিরসা মুন্ডার জন্মজয়ন্তী পালন করছিলেন। সেখানেই উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ইন্দর সিং পরমার (বিজেপি) বলে ফেললেন,
“ইংরেজরা ইংরেজি পড়িয়ে ধর্মান্তর করাত। তার জন্য কয়েকটা ভুয়ো সমাজসংস্কারক তৈরি করেছিল। রাজা রামমোহন রায় তাদের মধ্যে একজন। উনি ব্রিটিশদের এজেন্ট ছিলেন।”
ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে গেল।
বাংলা থেকে দিল্লি, কংগ্রেস-তৃণমূল-বাম সবাই চিৎকার শুরু করল,
“এটা কী বলছেন? যিনি বিধবাদের জ্যান্ত পোড়ানো বন্ধ করলেন, তাঁকেই ব্রিটিশের দালাল?”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তো সোজা বলে দিল, “এটা বাঙালির অপমান, বিজেপির বাংলা-বিদ্বেষ।”
পরদিনই মন্ত্রী ভিডিও বার করে ক্ষমা চাইলেন,
“মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। রামমোহন রায় মহান সমাজসংস্কারক। আমি অনুতপ্ত।”
কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার পরেও লোকে বলাবলি করছে, “এটা কি সত্যিই ভুলে বলা, নাকি মনের কথা বেরিয়ে গেল?”
আসলে এটা নতুন না।
কিছুদিন ধরেই কিছু লোক বলছে, রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগররা নাকি “ইংরেজের সাহায্য নিয়ে” ভারতীয় সংস্কৃতি নষ্ট করেছিলেন। কিন্তু যারা ইতিহাস পড়েছে তারা বলে, “উনি ইংরেজদের হাতিয়ার ব্যবহার করেছিলেন শুধু সতীদাহ, বাল্যবিবাহের মতো অত্যাচার বন্ধ করতে।”
মাত্র ছ’মাস আগেই (মে ২০২৫) রামমোহনের জন্মদিনে সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। আজ সেই মানুষটাকেই “দালাল” বলে দেওয়া হল।
রাজা রামমোহন রায় আসলে কী কী করে গেছেন?
ভাবো ২০০ বছর আগের কথা। তখনও বাংলা-ভারতে মেয়েদের পড়তে দেওয়া হত না, বিধবাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হত (সতীদাহ), বাল্যবিবাহ ছিল সাধারণ, পর্দা প্রথা ছিল কড়া, আর ধর্মের নামে হাজারো কুসংস্কার। এই অন্ধকারের মধ্যে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে বললেন, “এসব বন্ধ করতে হবে।” তিনিই রাজা রামমোহন রায়।
১. সমাজের জন্য যা করেছেন
- সতীদাহ প্রথা বন্ধ: সবচেয়ে বড় কাজ। তিনি দেখতেন বিধবা মহিলাকে জোর করে স্বামীর চিতায় তুলে পোড়ানো হচ্ছে। তিনি লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে গিয়ে প্রমাণ দিয়ে দেখালেন এটা হিন্দু শাস্ত্রেও বাধ্যতামূলক নয়। ১৮২৯ সালে সতীদাহ আইনত নিষিদ্ধ হল। হাজার হাজার মহিলার জীবন বাঁচল।
- বিধবাদের পুনর্বিবাহের পথ খোলা: তিনি বলতেন, বিধবারা যাতে আবার বিয়ে করতে পারে, সমাজে মাথা তুলে বাঁচতে পারে।
- বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই: ছোট্ট মেয়েকে বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বন্ধ করার জন্য লড়েছেন।
- মেয়েদের অধিকার: বলতেন, মেয়েরাও সম্পত্তিতে অংশ পাবে।
২. শিক্ষার জন্য যা করেছেন
- মেয়েদের স্কুল: কলকাতায় হিন্দু কলেজ (১৮১৭) গড়তে সাহায্য করেন। তারপর মেয়েদের জন্য স্কুল খোলার পক্ষে জোর লড়াই করেন।
- ইংরেজি শিক্ষা চালু: তিনি বুঝেছিলেন, আধুনিক বিজ্ঞান-দর্শন না পড়লে ভারত পিছিয়ে থাকবে। তাই ইংরেজি পড়ার পক্ষে ছিলেন। আজকে যাকে আমরা “মডার্ন এডুকেশন” বলি, তার পথ তিনিই খুলে দেন।
- সংবাদপত্র: “সম্বাদ কৌমুদী” নামে বাংলা পত্রিকা বার করেন। প্রথমবার বাংলায় সরকারের বিরুদ্ধে লেখা শুরু হয়। প্রেসের স্বাধীনতার জন্যও লড়েছেন।
৩. ধর্মের জন্য যা করেছেন
- ব্রাহ্মসমাজ (১৮২৮): মূর্তিপূজা, কুসংস্কার ছেড়ে শুধু এক ঈশ্বরে বিশ্বাস – এই নতুন ধর্ম আন্দোলন শুরু করেন। হিন্দু ধর্মকে আধুনিক ও যুক্তিবাদী করার চেষ্টা।
- সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা: হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান – সবার ভালো দিক নিতে বলতেন। তিনি নিজে বেদ-উপনিষদ, কোরান, বাইবেল সব পড়তেন।
৪. আরও কিছু বড় কাজ
- ভারতের প্রথম “নাগরিক আন্দোলন”: সরকারের কাছে পিটিশন দেওয়া, সভা করা, প্রচার করা – আজকের মতো সিভিল সোসাইটি তৈরি করেছিলেন।
- ইংল্যান্ডে গিয়ে লড়াই: ১৮৩০ সালে মুঘল সম্রাটের দূত হয়ে লন্ডনে যান। সেখানেই ১৮৩৩ সালে মারা যান।
এক কথায় বলতে গেলে –
যে ভারতে আমরা আজ মেয়েদের স্কুলে যেতে দেখি, বিধবারা আবার বিয়ে করতে পারে, মূর্তিপূজা না করলেও হিন্দু থাকা যায়, সংবাদপত্রে লিখতে পারি – এসবের পথ যিনি প্রথম খুলে দিয়েছিলেন, তিনিই রাজা রামমোহন রায়।
তাই তাঁকে বলা হয় “আধুনিক ভারতের জনক”।

Comments
Post a Comment